শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০

দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে | চতুর্থ কিস্তি |

[i]একটা আর্তনাদ শুরু হয়েই মিলিয়ে গেল। রক্তের দমকে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার বিশ্রী ঘড়ঘড়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। বাসিলের হাত দুটো শূন্যে উঠে গেল, যেন বাতাসে কিছু ধরার চেষ্টা করছেন। ডোরিয়ান আরও দু বার আঘাত করল তাঁকে। মেঝের ওপর এখন ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। তাঁর শরীরটা আর নড়ছে না। ডোরিয়ান চাকুটা ছুড়ে মারল টেবিলের ওপর। কান পাতল। শুধুই নীরবতা।[/i]
[i]
শুধু, সুতো ওঠা কার্পেটের গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ার শব্দ! অন্যকিছু কানে আসছে না। [/i]

[size=24][url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/33509][প্রথম কিস্তি][/url][/size] [size=24][url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/34761][দ্বিতীয় কিস্তি][/url][/size] [size=24][url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/34912][তৃতীয় কিস্তি][/url][/size]

[size=24]চতুর্থ কিস্তি[/size]

[size=20]পর্ব পনেরো ॥ খুন[/size]

বাসিল গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন, নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন টেবিলের পাশে পড়ে থাকা নড়বড়ে চেয়ারটাতে। ডোরিয়ান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে তার ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসছে।

‘কী একটা শিক্ষা, ডোরিয়ান! কী ভয়ংকর একটা শিক্ষা! প্রার্থনা, ডোরিয়ান, প্রার্থনা করো!’ উপদেশ দিলেন বাসিল। ‘শৈশবে আমাদের কী শেখানো হয়?—অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা! এসো আমরা একসাথে প্রার্থনা করি। তোমার দেমাগি প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে। তোমার অনুতপ্ত প্রার্থনাও মঞ্জুর হবে। আমি তোমার রূপের গভীর প্রশংসা করেছি—উভয়ে শাস্তিও পেয়েছি এর জন্যে।’

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে, বাসিল,’ ডোরিয়ান ভেঙে ভেঙে বলল।

‘কখনোই না, ডোরিয়ান। এসো নতজানু হই। একজীবনে যথেষ্ট পাপ করে ফেলেছ। দেখছ না ওই অভিশপ্ত ছবিটা কেমন ক্রুর চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে?’

ডোরিয়ান গ্রে একঝলক ছবিটার দিকে তাকাল। হঠাৎ করেই তার দুরন্ত ঘৃণা লাগছে লোকটাকে। অন্ধ ক্রোধ তাকে যেন কোনঠাসা পশুর মতো উত্তেজিত করে তুলছে। এত বেশি ঘৃণা সে জীবনে কিছুকে করেনি।

সে বন্য চোখে চারদিকে তাকাল। একটা চাকু তার দৃষ্টি কেড়ে নিল, নিরীহ ভঙ্গিতে সিন্দুকের ওপর পড়ে আছে ওটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেদিকে, বাসিলকে অতিক্রম করছে।

বাসিলের পেছনে যাওয়া মাত্র ডোরিয়ান চাকুটা হাতে তুলে নিল। একটুও দেরি না করে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল বাসিলের দিকে। সজোরে চাকুটা বসিয়ে দিল তাঁর কানের পেছনে। একহাতে লোকটার মাথা ঠেসে ধরে রেখেছে টেবিলের ওপর, চাকুটা বারবার নামছে, উঠছে।

একটা আর্তনাদ শুরু হয়েই মিলিয়ে গেল। রক্তের দমকে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার বিশ্রী ঘড়ঘড়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। বাসিলের হাত দুটো শূন্যে উঠে গেল, যেন বাতাসে কিছু ধরার চেষ্টা করছেন। ডোরিয়ান আরও দু বার আঘাত করল তাঁকে। মেঝের ওপর এখন ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়া শুরু হয়েছে। শরীরটা আর নড়ছে না। ডোরিয়ান চাকুটা ছুড়ে মারল টেবিলের ওপর। কান পাতল। শুধুই নীরবতা।

শুধু, সুতো ওঠা কার্পেটের গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ার শব্দ! অন্যকিছু কানে আসছে না। ডোরিয়ান দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে এল। রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়িঘরে উঁকি দিল। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ঘরে ফিরে আবার দরজায় তালা লাগিয়ে দিল সে।

কত দ্রুত সে এটা করেছে! ডোরিয়ান গ্রে তবু আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত হয়ে আছে, দাঁড়াল গিয়ে খোলা ব্যালকনিতে। বাতাসের ঝাপটায় কুয়াশা সরে সরে যাচ্ছে। ময়ুরপুচ্ছের মতো আকাশ তার দিকে তিরস্কার-মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সে নিচে তাকাল। একজন নিঃসঙ্গ পুলিশ টহল দিচ্ছে, তার হাতের লণ্ঠন থেকে লম্বা আলো গিয়ে পড়ছে বাড়িঘরের নীরব আঙিনায়। একজন পথচারী একাকী টলমল পায়ে শব্দ করতে করতে যাচ্ছে।

একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল জায়গাটার ওপর দিয়ে। গ্যাসবাতিগুলো নিভু নিভু হয়ে নীল বর্ণ ধারণ করল, পাতাশূন্য গাছগুলোর শাখা-প্রশাখা দুলছে সামনে-পেছনে। ডোরিয়ান তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। ঠাণ্ডায় তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। এই মৃত্যু ও ধ্বংসের ঘর থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেন তার ভেতর মাথা কুটে মরছে।

নষ্ট করার মতো একটুও সময় নেই হাতে। এক্ষুনি এ ঘর থেকে তাকে বেরোতে হবে। নিহত লোকটার দিকে সে তাকাল না পর্যন্ত। বিড়ম্বিত ছবিটা যাঁর আঁকা, সেই বন্ধুটা তার জীবন থেকে সরে গেছে এটাই যথেষ্ট।

ডোরিয়ান দরজায় তালা দিয়ে নিঃশব্দে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। বাসিলের কোট এবং ব্যাগ তার চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি সে লুকিয়ে ফেলল সেগুলো, মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কী প্রমাণ আছে তার বিরুদ্ধে? বাসিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন রাত এগারোটায়। তাঁকে কেউ ফিরে আসতে দেখেনি। বেশির ভাগ ভৃত্য শহরের বাইরে, কান্ট্রি হাউসে। মধ্যরাতের ট্রেনে প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল বাসিলের। কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর অনুপস্থিতি কেউ টের পাবে না। অনেক সময়! তত দিনে সব প্রমাণ মুছে ফেলা যাবে।

হঠাৎই তার মাথায় এল চিন্তাটা। একটা অ্যালিবাই থাকা দরকার। শরীরে হ্যাট এবং কোট চাপিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরই আবার ফিরে এসে প্রধান ফটকের বেল বাজাল। খানসামা একটু দেরি করেই দরজা খুলল, সে বেচারার চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে আছে।

‘তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে দুঃখিত, ফ্রান্সিস,’ ডোরিয়ান বলল। ‘কিন্তু আমি চাবি ফেলে গেছি। আমার খোঁজে কেউ এসেছিল?’

‘মি. হলওয়ার্ড, স্যার। কিন্তু তিনি রাত এগারোটায় চলে গেছেন ট্রেন ধরার জন্যে।’

‘ওহ্! আমি দুঃখিত যে তার সাথে দেখা হলো না। তিনি কি কোনো বার্তা দিয়ে গেছেন?’ ডোরিয়ান ধূর্ততার সাথে জিজ্ঞেস করল।

‘না স্যার, তবে বলে গেছেন প্যারিস থেকে চিঠি লিখবেন।’

‘ঠিক আছে, ফ্রান্সিস। কাল সকাল ন-টায় আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ো। শুভরাত্রি।’

[size=20]পর্ব ষোল ॥ অন্যায়ের চিহ্ন অদৃশ্য[/size]

পরদিন সকাল ন-টা।

এক কাপ গরম চকোলেট নিয়ে ভিক্টর ঘরে প্রবেশ করল এবং জানালার খড়খড়ি তুলে দিল।

ডোরিয়ান পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তাকে দেখাচ্ছে একটা ছোট্ট শিশুর মতো, যেন খেলাধূলায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! ডোরিয়ানকে ঘুম থেকে তোলার জন্য তার খানসামাকে দু বার কাঁধ ধরে ঝাকাতে হলো।

ডোরিয়ান পাশ ফিরে শুল, কনুইয়ে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে তরল চকোলেটে। নভেম্বরের পাকা রোদ যেন স্রোতের মতো ঘরের ভেতর ঢুকছে। আকাশ একদম পরিষ্কার, বাতাসে উষ্ণতার ছাপ। পুরোপুরি মে-র সকালের মতো আবহাওয়া।

কিন্তু ধীরে ধীরে, রক্তাক্ত পায়ে, গত রাতের ঘটনাপ্রবাহ আবার তার মাথায় আসতে শুরু করেছে। সে একজন মানুষকে খুন করেছে। এবং লাশটা এখনও তার বাড়ির ভেতরেই আছে!

পানীয় শেষ করে সে টেবিলে বসে গেল চিঠি লেখার জন্য। দুটো চিঠি লিখল সে। একটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে অন্যটা তার খানসামার হাতে দিয়ে মি. অ্যালান ক্যাম্পবেল, ১৫২ হার্টফোর্ড স্ট্রীট—এই ঠিকানায় দিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিল। ডোরিয়ান চায় অ্যালান ক্যাম্পবেল যেন অবিলম্বে তার বাড়িতে আসে।

আঁকাজোকা করে আর বই পড়ে ডোরিয়ান সকালটা কাটিয়ে দিল। কিন্তু দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না। কী হবে যদি অ্যালান ক্যাম্পবেল দেশের বাইরে থাকে? আরও খারাপ কথা, যদি সে দেখা করতে অস্বীকার করে? মোটের ওপর, তারা তো আর এখন বন্ধু নয়। একসময় তারা ঘনিষ্ঠ ছিল, সেটা বছর পাঁচেক আগের কথা। তারপর বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ করে, সম্পূর্ণভাবে।

কখনো যদি দেখা হয়ে যায়, শুধু ডোরিয়ান কথা বলে, বা বলা ভালো, বলার চেষ্টা করে। এবং বলাই বাহুল্য, কথা এগোয় না।

অ্যালান ক্যাম্পবেল দারুণ বুদ্ধিমান ও টগবগে এক তরুণ, যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে বিজ্ঞানের জন্য। যখন সে ক্যামব্রিজে পড়ত, দিনের বেশির ভাগ সময় গবেষণাগারে পড়ে থাকত। সে একজন অসাধারণ সংগীতজ্ঞও বটে এবং সংগীতই তাদের দু জনকে প্রথমে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।

এখনো কেউ জানে না তাদের ঝগড়া কী নিয়ে। কিন্তু আর সবাই তাদের বিরল কথোপকথন লক্ষ করেছে। এমনকি কোনো পার্টিতে ডোরিয়ান গ্রে উপস্থিত হলে ক্যাম্পবেল সেখান থেকে চলে যায়। সে বদলেও গেছে অনেক—প্রায় সময়ই তাকে বিষণ্ন দেখায়। এখন সংগীত তার কাছে অরূচিকর, নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছে বিজ্ঞানের সাধনায়।

ডোরিয়ান হলময় পায়চারি শুরু করল। উত্তেজনা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সময় যেন থমকে গেছে। অবশেষে দরজাটা খুলে গেল। ‘মি. ক্যাম্পবেল, স্যার,’ খানসামা বলল। ডোরিয়ান বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

‘তাকে এই মুহূর্তে ভেতরে নিয়ে এসো, ফ্রান্সিস,’ ডোরিয়ান যেন নিজেকে ফিরে পেয়েছে। এখন সে খুব তাড়াতাড়িই অপরাধের সব প্রমাণ মুছে ফেলতে পারবে।

অ্যালানের চেহারা কঠোর হয়ে আছে, একটু যেন ফ্যাকাশেও। দুই সাবেক বন্ধু মুখোমুখি চেয়ারে বসল। দুজোড়া চোখের মিলন ঘটল। ডোরিয়ান জানে সে একটা ভয়ংকর কাজে হাত দিতে যাচ্ছে!

‘আসার জন্যে ধন্যবাদ, অ্যালান।’

‘তুমি লিখে পাঠিয়েছ এটা জীবন-মৃত্যুর বিষয়,’ অ্যালান বলল। ‘আমি অবশ্য গ্রাহ্য করি না। আর এটা জানাতেই আমি এসেছি। তোমার সঙ্গে কোনো কাজ করার ইচ্ছে আমার নেই। আমি তোমার কলঙ্কিত জীবনের সাথে জড়াতে চাই না।’

ডোরিয়ান শান্তভাবে অ্যালানের জ্বালাময়ী বক্তব্যটি শুনল। সে একটু চিন্তা করল। তারপর সামনে ঝুঁকে বসল, কথা বলছে কোমল স্বরে, ‘অ্যালান, আমি একজনকে খুন করেছি। তুমি ভাবতেও পারবে না সে আমার কতটা ক্ষতি করেছে। অ্যালান, লাশটি ধ্বংস করতে আমাকে সাহায্য করো। তুমি একজন ডাক্তার,’ সে যোগ করল, ‘তুমি জানো কীভাবে আমি রেহাই পেতে পারি। একমাত্র তুমিই আমাকে রক্ষা করতে পার। তোমাকে জড়াতে আমি বাধ্য হয়েছি। আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না।’

‘তোমাকে সাহায্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই, ডোরিয়ান,’ অ্যালান রায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল।

‘অ্যালান, তুমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। তুমি রসায়ন এবং এ ধরনের বস্তু সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখ। এ বিষয়ে অনেক পরীক্ষাও চালিয়েছ। তুমি শুধু ওপরতলায় যে লাশটি পড়ে আছে তা ধ্বংস করে দেবে—ধ্বংস করবে এমনভাবে, যেন এর কোনো চিহ্নই না থাকে,’ ডোরিয়ান নির্দেশনা দিল।

‘কেউ লোকটাকে এ বাড়িতে আসতে দেখেনি। সত্যি, এ মুহূর্তে তাঁর প্যারিসে থাকার কথা। কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর খোঁজ পড়বে না। যখন সবাই টের পাবে, তত দিনে তাঁর কোনো চিহ্ন এখানে থাকবে না। অ্যালান, তুমি অবশ্যই তাঁকে, তাঁর সবকিছুসহ, এক মুঠো ছাইয়ে পরিণত করবে—যা আমি বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারব।’

‘তুমি বদ্ধ উন্মাদ, ডোরিয়ান,’ অ্যালান ক্যাম্পবেলের কণ্ঠ বরফের মতো শীতল শোনাল। ‘উন্মাদ না হলে কীভাবে চিন্তা করলে এই ভয়ংকর স্বীকারোক্তির পরেও তোমাকে সাহায্য করব। এ বিষয়ে আমার কিছুই করার নেই। তোমার কী হবে তা আমি পরোয়া করি না। এটাই তোমার পাওনা!’

‘তোমাকে কিছু করতেই হবে। অপেক্ষা করো এবং আমার কথা শোনো, অ্যালান,’ ডোরিয়ান জেদ ধরল।

‘খুন! হাঁ ঈশ্বর, ডোরিয়ান! এজন্যেই তুমি দুনিয়ায় এসেছ? আমি পুলিশকে জানাব না। এটা আমার বিষয় নয়। তা ছাড়া, তুমি এমনিতেই গ্রেপ্তার হবে। প্রতিটা অপরাধীই বোকার মতো কিছু না-কিছু করে বসে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।’

প্রাক্তন বন্ধুর কথায় ডোরিয়ানের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে যখন কথা বলা শুরু করল, তাকে নিজের মতে সম্পূর্ণ অটল দেখাল, ‘অ্যালান, আমি যা বলছি—তোমাকে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতে হবে। তুমি যখন হাসপাতালে বা মর্গে যাও, সেখানকার আতঙ্ক তো তোমাকে স্পর্শ করে না! যদি ভয়ংকর কোনো গবেষণাগারে সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে একটা লাশকে টেবিলে পড়ে থাকতেও দেখ, তুমি তো খুব সাধারণভাবে তাকাবে যেন ওটা খুব আকর্ষণীয় একটা বিষয়।

তোমার তো মনে হবে না তুমি কোনো অন্যায় কাজ করছ। যে কাজটি তোমার কাছ থেকে আশা করছি, প্রায় সে ধরনের কাজ তুমি আগেও করেছ। এবং মনে করিয়ে দেই, আমার বিরুদ্ধে এটাই একমাত্র প্রমাণ। এটা যদি উদ্ধার হয়, আমি ধ্বংস হয়ে যাব। আমাকে যদি সাহায্য না কর ঠিক তা-ই ঘটবে।’

‘অ্যালান, অনুগ্রহ করো,’ ডোরিয়ান গ্রের চোখে রাগ মেশানো করুণা প্রার্থনার দৃষ্টি। ‘আমার অবস্থানের কথা একবার চিন্তা করো। তুমি আসার আগে আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। দয়া করো, আমরা একসময় বন্ধু ছিলাম।’

‘ওইসব দিনের কথা আমার সামনে উচ্চারণ কোরো না। সেসব এখন মৃত,’ অ্যালান উত্তর দিল।

‘কিন্তু, অ্যালান, তুমি সাহায্য না করলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কর্তৃপক্ষ আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে!’ ডোরিয়ান চিৎকার করল।

‘তোমার দয়াভিক্ষা শোভা পায় না, ডোরিয়ান,’ অ্যালান আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে আছে। ‘আমি পুরো ব্যাপারটা প্রত্যাখ্যান করছি। এটা তোমার নির্বোধ আচরণ। তুমি নিজেই বিপদে ডেকে এনেছ। আমার কোনো সম্পর্ক নেই এর সাথে। সমস্যা তৈরি করেছ তুমি, সমাধানও তুমিই করবে।’

‘তুমি কি নিশ্চিত যে আমাকে সাহায্য করবে না?’ ডোরিয়ান শেষবারের মতো জানতে চাইল।

‘আমি নিশ্চিত,’ অ্যালান বলল।

ডোরিয়ান এক মুহূর্ত থম মেরে রইল। তারপর এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়ে কিছু একটা লিখল সেটার ওপর। সাবধানে সেটা ভাঁজ করে তুলে দিল ক্যাম্পবেলের হাতে। লেখাটায় এমন কিছু ছিল যে পড়তে গিয়ে ক্যাম্পবেলের চেহারা ভূতের মতো সাদা হয়ে গেল। তার দারুণ অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে, হৃদপিণ্ডটা এমনভাবে ধুকপুক করছে যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবে।

কয়েক মিনিটের শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা, তারপর ডোরিয়ান কথা বলল। ‘আমি দুঃখিত, অ্যালান। কিন্তু তুমি আর কোনো বিকল্প রাখনি। তুমি যদি সাহায্য না কর, কাগজে নাম উল্লেখ করা লোকটার কাছে আমি চিঠিটা পাঠিয়ে দেব। এখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করা তোমার জন্যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ক্যাম্পবেল মাথা নেড়ে সায় দিল, পরাজয় মেনে নিয়েছে। সে গালে হাত দিয়ে বসে রইল দীর্ঘক্ষণ, একটা কাঁপুনি বয়ে গেল তার শরীর দিয়ে। সে জানে তার আর অন্য কোনো উপায় নেই—ডোরিয়ান গ্রে-কে প্রত্যাখ্যান করা মানে নিজের জীবন বিপন্ন করা!

‘হ্যাঁ, এখন আমার কথামতোই তোমাকে চলতে হবে, অ্যালান। তুমি জানো আমি কী বোঝাতে চাইছি। আমি যা চেয়েছি শুধু তা-ই করো।’ ডোরিয়ান তার একটা হাত রাখল অ্যালানের কাঁধে। এই সামান্য ভারেই যেন নুয়ে পড়ল সেটা। অ্যালান তার সহকারীকে খবর দিল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে আসার জন্য বলল। যখন সবকিছু এসে পৌঁছাল, ডোরিয়ান তাকে সিঁড়ির ওপর নিজের খেলাঘরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।

ডোরিয়ান দরজা খুলল আর খুলেই সূর্যের প্রখর আলোয় ছবিটার মুখ দেখতে পেল। তার মনে পড়ল গত রাতে সে ভুলে গেছে, জীবনে এই প্রথমবারের মতো, বিড়ম্বিত ক্যানভাসটি ঢেকে রাখতে। এটা কী আতঙ্কজনক! ওই লাল বিন্দুটা কী, যা তার একটা হাতের ওপর জ্বলজ্বল করছে? ক্যানভাসটি কি রক্ত ঝরিয়েছে?

দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে, ডোরিয়ান একপাশ থেকে কাপড়টা তুলে নিল এবং ভূতে-পাওয়া ছবিটা ঢেকে রাখল।

‘আমাকে একা থাকতে দাও,’ অ্যালান আদেশ করল। ‘এটা কয়েক ঘণ্টা সময় নেবে।’

ডিনারের সময় হওয়ার আগেই, অ্যালান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। ‘তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি,’ সে তিক্ততার সাথে বলল। ‘আমি আর তোমার মুখ দেখতে চাই না।’

-----------------------------------
কুটুমবাড়ি
mhdrakib@gmail.com
-----------------------------------

ছবিসূত্র : ১. [url=http://www.google.com/imgres?imgurl=http://www.pinkkryptonite.com/images/pinkkryptonite/dorian.jpg&imgrefurl=http://www.pinkkryptonite.com/2008/01/the_picture_of_dorian_gray.html&usg=__B8sqOXWxPjF6RleAopGNX1-8vhc=&h=456&w=300&sz=41&hl=en&start=42&sig2=ut0wPZJaCSgWsgXmrLxkIA&zoom=1&tbnid=ViKUh4NT5uSmEM:&tbnh=125&tbnw=82&ei=-rCTTIG_D8yM4gajvpDyAw&prev=/images%3Fq%3Dthe%2Bpicture%2Bof%2Bdorian%2Bgray%26hl%3Den%26biw%3D1016%26bih%3D543%26gbv%3D2%26tbs%3Disch:10%2C798&itbs=1&iact=hc&vpx=687&vpy=183&dur=318&hovh=174&hovw=114&tx=94&ty=191&oei=eLCTTJLbI9CDswaogv2FCQ&esq=12&page=3&ndsp=21&ved=1t:429,r:12,s:42&biw=1016&bih=543]pinkkryptonite.com[/url]
২. [url=http://www.squidoo.com/Artist-Plutenko]squidoo.com[/url]

বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১০

বানানায়তন- ২ | ও কি এল, ও কি এল না |

যারা প্রথম পর্ব পড়েননি [url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/33356]এখানে[/url] ক্লিক করুন।

বাংলায় লিখতে চান, অথচ বানানকে ভয় পান না এমন লোক কমই আছে। বাজারে প্রচলিত স্পেল চেকারগুলো তেমন কার্যকরী নয়। আর যদি কখনও হয়ও, স্বাবলম্বী হওয়াটাই ভালো মনে করি। অন্তত যতটুকু সম্ভব। বিশেষত যখন বানানরীতি একটি চলমান বিষয়। এবং বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলাটাও যখন আজকের নয়।

যতটুকু জানা যায়, আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা বানানে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছিল। তখন ‘বাংলা বানান ছিলো স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী–লেখক বা লিপিকরের উচ্চারণ অনুসারেই লিখিত হতো বানান।’ (হুমায়ুন আজাদ, বাংলা ভাষা, প্রথম খণ্ড)।

ঐতিহ্যগতভাবে পালির সাথে বেশি মিল থাকলেও মধ্যযুগে, বিশেষত