শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০১০

আমি ডাক্তার নই

লিখেছেন কুটুমবাড়ি (তারিখ: রবি, ২০১০-০৬-১৩ ২৩:৩৫)@ সচলায়তন
ক্যাটেগরী: অণুগল্প | সায়েন্স ফিকশন | সববয়সী

রোবটরা আমাকে ভালোবাসে।

অবশ্য রোবটদের পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা। এবং জৈবনিক বিচারে, অবশ্যই। আমার চেহারায় নাদুশনুদুশ শিশুসুলভ একটা ব্যাপার আছে। হয়তো এটা ওদের কপোট্রনিক মস্তিষ্কের বাবাসুলভ প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে। যার দরুন তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হয়। আর এ ব্যাপারটা আমার দায়িত্ব পালনে খুবই সাহায্য করে।

বসার ঘরের মাঝখানে অনড় পড়ে থাকা রোবটটার সামনে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। রোবটটা নীল রঙের, আকারে ঢাউসই বলতে হয়। বেশ কয়েক বছরের পুরোনো মডেল এটা। এখন প্রায় মানুষের মতোই দেখতে যেসব অত্যাধুনিক রোবট বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে ফেলেছে, ও-রকম নয় মোটেই।

আমার পেছনে পুরো পরিবার এসে জড়ো হয়েছে। দুঃখিত, চিন্তিত।

“আপনি কি তাকে সুস্থ করতে পারবেন?” মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর কোমল মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটিকে কাছে টেনে নিলেন তিনি। মি. রহমান আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত রাখলেন স্ত্রীর কাঁধে। যদিও মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনিও কম মুষড়ে পড়েননি।

“আমি ডাক্তার নই,” কিছুটা অন্যমনষ্ক সুরে বললাম আমি, চোখ সেঁটে আছে স্ক্যানারের দিকে।

“মাফ করবেন?” মি. রহমান তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এলেন, চমকে গেছেন কিছুটা।

“হুমম?” জিজ্ঞেস করলাম আমি, ঘোর কাটিয়ে উঠছি।

“ওহ্! আমি ডাক্তার নই। রোবটদের আসলে মস্তিষ্ক নেই, তাই তাদের সাইকিয়াট্রিস্ট বা এ জাতীয় কিছুর প্রয়োজন হয় না...” কাজের দিকে আবার মনোযোগ ফিরিয়ে নেয়ার আগে বললাম আমি। “আমি একজন টেকনিশিয়ান।”

“জুডার হঠাৎ করেই এখানে বসে পড়েছে, আর নড়ছে-চড়ছে না,” কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে ছোট্ট মেয়েটি বলল।

“কয়েক দিন আগেই তাকে আমরা সার্ভিসিং করিয়ে এনেছি। সবকিছু ঠিকই ছিল তখন,” মিসেস রহমান যোগ করলেন। “বুঝতে পারছি না ওর কী হয়েছে।”

আমি মাথা নেড়ে “হুমম” শব্দ করলাম, আসলে মনোযোগ নেই ওদের কথায়। “ইউনিট LP-3830, আমার কথার উত্তর দাও।”

“জুডার,” রোবটটার কণ্ঠ আশ্চর্য রকম মানুষের মতো, আমার কথা সংশোধন করে দিল। ওটা এখনও নড়েনি, তার ঝাপসা ফটোরিসিপ্টরে আলোর কোনো চিহ্নই নেই।

“আচ্ছা ঠিক আছে,” মেনে নেয়ার ভঙ্গিতে বললাম আমি। “তা জুডার, তোমার সবকিছু ঠিক-ঠাক মতন কাজ করছে তো?”

ওটা নরম শ্বাস ছাড়ল, “যদি তোমরা একে তা-ই বলো।”

আমি ওর সামনে কার্পেটের ওপর পা ভাঁজ করে বসলাম। “হেই, কী হয়েছে বলবে আমাকে?” আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। জুডারের চোখে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল।

“রেডফোর্ডরা নতুন রোবট কিনেছে,” অবশেষে ওটা কথা বলল।

“হ্যাঁ,” মি. রহমান আমার পেছন থেকে সাড়া দিলেন। “আমাদের দুটো বাড়ি পরেই ওদের বাসা। নতুন N-70 সিরিজের একটা রোবট কিনেছে ওরা।”

“বলে যাও,” আমি ওটাকে উৎসাহ দিলাম।

“ওটা বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়া করে, বাড়ির টুকটাক সারাইয়ের কাজ করে, এবং তার আছে সম্প্রসারণযোগ্য বাহু এবং বাগানের ঝোপ পরিষ্কার করার একটি বাড়তি উপকরণ, এবং...”

“এবং সে তুলনায় তোমার নিজেকে খুবই সাদামাটা আর সেকেলে মনে হচ্ছে?” নরম সুরে বললাম আমি।

“এই N-70 সিরিজের রোবটগুলি এত অসাধারণ,” ওটা বলল। “ওই ধরনের একটা রোবট এ পরিবারের অনেক বেশি কাজে আসবে। আমার চেয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারবে ওটা।”

“জুডার, তোমাকে এখন মানব প্রজাতির একটা গোপন রহস্য বলব। এটা কিছুটা স্ববিরোধী মনে হতে পারে, প্রতিজ্ঞা করো আমার কথা শুনে তোমার মাথা বিস্ফোরিত হবে না।”

ওটা মাথা নাড়ল, চোখ আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

“জুডার,” আমি বললাম। “মানুষ আবেগীয় সম্পর্ক তৈরি করে। তারা সব সময়ই নতুন এবং চকচকে জিনিসের পেছনে ছোটে না। তারা তা-ই চায় যা তারা ভালোবাসে।”

“তাঁরা আমাকে ভালোবাসেন?” ওটা জিজ্ঞেস করল, তাকিয়ে আছে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে। ওখানে, ওর জন্য অপেক্ষা করছিল অভাবিত মনুষ্যত্ব। ওটা উঠে দাঁড়াল, এবং এক মুহূর্ত পর, আমিও।

“ডাক্তার,” জুডারের কণ্ঠ খুশি খুশি শোনাল। “এটা একেবারেই অযৌক্তিক।”

“জুডার,” আমি হাসলাম, “আমি ডাক্তার নই।”

দায়স্বীকার : ব্রায়ান সি. বায়েরের লেখা দ্য রোবট হুইসপার গল্প অবলম্বনে রচিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন