শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০১০

প্রমিত বাংলা বানানরীতি, প্রশ্ন অপরিমিত : প্রয়োজন, দায়, না বাতুলতা?

লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২০১০-০৬-২২ ০৮:০৭)@ সচলায়তন
ক্যাটেগরী: ব্লগরব্লগর

‘বাংলা একাডেমী’ প্রবর্তিত প্রমিত বাংলা বানানরীতি সম্বন্ধে না জেনেই তা উড়িয়ে দেবার একটা প্রবল প্রবণতা রয়েছে আমাদের মধ্যে। বাংলা ভাষায় একটা প্রমিত বানানরীতি যে প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে তা মেনে নিতেও আমাদের ভীষণ আপত্তি। একটা ভাষা যদি তার সব ব্যবহারকারীর জন্য হয় তো তার বানানের ক্ষেত্রে একটা মানরীতিই সব থেকে নিরাপদ যা সকলের জন্য সহজবোধ্য। প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ না করার অন্ধ প্রতিজ্ঞা ও গোয়ার্তুমি বাংলাকে একটা জগাখিচুড়ি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে হয়তো রীতি তৈরিই হয় ভাঙার জন্য, তাতে হয়তো রীতিরই লাভ, কারণ সে রীতির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা যাচাই হয়ে যায় এতে। কিন্তু তা যদি হয় বিচার-বিবেচনাহীন, অগ্রহণযোগ্য রীতির রক্ষাকবচ, তাহলে বাংলা ভাষার মানদণ্ড কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবে দেখবার বিষয়।

প্রথমেই বলে নিই অতিরিক্ত বানান-চিন্তাকে যাঁরা শুচিবায়ুগ্রস্ততা বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চান আমি তাঁদের দলে নই। মানসম্পন্ন লেখাও ভুল/অপ্রমিত বানানের কোপে পড়ে পাঠযোগ্যতা হারিয়ে ফেলতে পারে—এই আমার বিশ্বাস। হ্যাঁ, ভুল বানান থাকবে, তবে তা বড়জোর ডায়েরির পাতায় বা বাজারের ফর্দতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। সাইনবোর্ড-ফেস্টুন-বিজ্ঞাপন কি গণমাধ্যম বা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ভুল বানানের দৌরাত্ম কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

যাঁরা ব্লগে লেখালেখি করছেন, তাঁরা কতখানি সচেতন বানানের বিষয়ে? আমি শব্দপ্রেমী, বানান ভুল আমাকে পীড়িত করে। হয়তো আমার মতো অনেক পাঠকই বিরক্ত হন। তবে ভুল তো ভুলই, আমার আপত্তি ইচ্ছাকৃত ভুল বা অপ্রমিত বানানে।

অনেকেই প্রমিত বানানরীতিকে বাড়তি দায় বলে মনে করতে পারেন। যেখানে বাংলায় শুদ্ধ বানানে লেখাই কষ্টকর, সেখানে প্রমিত বানানরীতি চাপিয়ে দেওয়াটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তা ছাড়া প্রমিত বানানরীতি ভাষাকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলবে বলেও অনেকের আশঙ্কা থাকতে পারে। এ আশঙ্কা কতটা যৌক্তিক আর কতটা অজ্ঞতা/উন্নাসিকতার পরিচয় তা নির্ণয় করার জন্যই এই আপাত বেহুদা লেখাটি পোস্টাতে হলো।

বাংলা ভাষায় পণ্ডিতের সংখ্যা বেশি, তাই সবাই নিজস্ব বানানরীতি রচনা করেন, আর বাংলা ভাষার/বানানের কর্ণধার কর্তৃক প্রণীত প্রমিত বানানরীতিকে থোরাই কেয়ার করেন। যদিও প্রমিতকরণের জন্য যে পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল, সেই পর্ষদও কিছু কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তেমনি জাতীয় শিক্ষাবোর্ডের বানানরীতিও অনেক ক্ষেত্রে প্রমিত বানানরীতির অনুরূপ নয়। পাশাপাশি পত্রিকাগুলোর যথেচ্ছাচার তো আছেই। এমন অবস্থায় বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা তো দিশেহারা হবেনই।

তবে আশার কথা হলো, যথেচ্ছাচার সত্ত্বেও ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বাংলা একাডেমী’ বানান বিষয়ে যে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে তা পরবর্তীকালে পত্র-পত্রিকাগুলোকে অনুসরণ করতে দেখা যায়, যদিও পুরোপুরি নয় [২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত 'বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে'র (পরিমার্জিত সংস্করণ) ‘পরিশিষ্ট’ হিসেবে মুদ্রণের পূর্বে ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুনরায় সংশোধন করা হয়। এখন প্রমিত বানানরীতির এই রূপটিই চালু আছে]। যতটুকু ব্যত্যয় চোখে পড়ে তা হতে পারে অজ্ঞাতসারে, অথবা 'নিজস্ব স্টাইল’-এর কারণে। প্রমিত বানানরীতি গ্রহণ ও ‘কোনো অসঙ্গতি থেকে থাকলে’ তা সংশোধনের জন্য একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। সবাই প্রমিত বানানরীতিকে গ্রহণ করলে আপনা-আপনিই তা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে ও চর্চিত হবে।

নিচে প্রশ্নোত্তর-আকারে 'বাংলা একাডেমী' প্রণীত প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো। ভবিষ্যতে প্রমিত বানানের নিয়মসমূহ ও সেগুলো মেনে চলায় আমাদের কী লাভ হবে তা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। দু-একটি নিয়মে আমার নিজেরও আপত্তি আছে, সেগুলোও আলোচনায় উঠে আসবে। এ ছাড়া সবার সম্মিলিত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু অজানা বিষয় জানতে পারব ও নিজেদের কোনো ভুল থেকে থাকলে তা সংশোধন করতে পারব বলে আশা করছি। যাঁরা কোনো-না-কোনোভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত তাঁদের সবাইকে মতামত জানাতে আহ্বান জানিয়ে রাখছি এই সুযোগে।

প্রশ্ন : ১. প্রমিত বাংলা বানানরীতি প্রণয়নের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি?

উত্তর : অনেক চলমান ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তখন একসময়ে বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। এ-যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি অনুযায়ী, নানা বানানের যেসব বিশৃঙখলা ও বিভ্রান্তি আমরা দেখছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলিকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল বেশি। বিকল্প হয়তো পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে ‘বাংলা একাডেমী’ বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।

প্রশ্ন : ২. একই শব্দ একাধিক বানানরীতিতে লিখতে অসুবিধা কোথায়? মানুষের ভাষায় বৈচিত্র্য/ফ্লেক্সিব্লিটি থাকা প্রয়োজন, ওতে ভাষার প্রাণ বাড়ে।

উত্তর : প্রতি ভাষারই একটা স্ট্যান্ডার্ড বানানরীতি থাকে- খুব সহজ উদাহরণ হলো ইংরেজি; হয় ইউএস অথবা ব্রিটিশ রীতি, এর বাইরে আরেকটা রীতি তারা অনুসরণ করে কি না তা আমার জানা নেই। তাই বলে সে ভাষায় বৈচিত্র্য/ফ্লেক্সিব্লিটি-র কিছুমাত্র ঘাটতি আছে কি?

বাংলা ভাষায় হয়তো শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। তবে বানানরীতিতে ভিন্নতা আনাটা কিছুতেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তাতে বিভ্রান্তি বাড়বে বৈ কমবে না।

আমি মনে করি বানানের বিষয়টা একান্তই ভাষাতত্ত্ববিদের কাজ, তবে তারা কিন্তু কিছুতেই ভাষার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন না, সে এক্তিয়ারও তাদের নেই। ভাষা পরিবর্তিত হয় গণ-মানুষের হাতে, লেখক-কবিরা তাতে আরও বেশি প্রাণ সঞ্চার করেন মাত্র। প্রমিত বানানরীতি লেখকের পায়ে বেড়ি পড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়নি, এটা করা হয়েছে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সুবিধার কথা ভেবেই।

ভাষাটা বিভিন্ন ব্যক্তির প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হতে পারে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মৌলিক বানানের ক্ষেত্রটা তো অভিন্ন করা যায়। এ নিয়মটা সবাই অনুসরণ করলে হয়তো পাঠক বিভ্রান্তিতে পড়বেন না এবং ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা সমতা বজায় থাকবে।

প্রশ্ন : ৩. ভাষার ক্ষেত্রে কিছু জিনিসকে ‘প্রমিত’ ঘোষণার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে একই সঙ্গে অনেক কিছুকে ‘অপ্রমিত’ ঘোষণা করার ভার।

উত্তর : কিছু জিনিসকে ‘প্রমিত’ ঘোষণায় কোনো সমস্যা দেখছি না। হ্যাঁ, এর জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন হবে এ কথা সত্য। কিন্তু এটা তো চলমান প্রক্রিয়া, তাই না? এ পর্যন্ত যেসব বানান প্রমিত হিসেবে মোটামুটি প্রণিধানযোগ্য হয়েছে সেগুলোকে তো আমরা মেনে নিতে পারি এবং অনুসরণ করতে পারি। আর যেসব বানানকে শুদ্ধ/গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না সেগুলো সবাই বর্জন করলে আপনা-আপনিই কালপরিক্রমায় হারিয়ে যাবে, আলাদা করে ‘অপ্রমিত’ ঘোষণার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

প্রশ্ন : ৪. প্রমিত বানানের আগে রচিত হাজার হাজার বইয়ের কী হবে?

উত্তর : ভাষা একটি চলমান বিষয়। তা না-হলে ৫০ বছর আগের ভাষা আর বর্তমান ভাষা একই রকম হতো। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। পুরোনো সেসব বইয়ের বানান সংস্কারের কথা কেউই বলছেন না, বরং সেই অমূল্য সাহিত্যভাণ্ডার যেমন আছে তেমন থাকাটাই সবার কাম্য। সেই এত দিন ধরে বাংলা বানান যে ক্রমাগত রূপ পরিবর্তন করে চলেছে তা বাংলা ভাষার জীবনীশক্তি এবং প্রবহমানতারই বহিঃপ্রকাশ। তাহলে এ-প্রজন্ম ঠিক কোন বানানরীতিটি অনুসরণ করবে তা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। ঠিক এখানেই প্রমিত বানানরীতি মেনে নেওয়ার প্রশ্নটি আসছে।

প্রশ্ন : ৫. রীতি যে সবাইকে মানতেই হবে এমন নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রীতির অনেকগুলো বানান মানতেন না।

উত্তর : প্রমিত বানানরীতির কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মের বিপক্ষে আপনার যদি কোনো যু্ক্তিগ্রাহ্য মতামত থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। নতুবা কেন মেনে নেবেন না? আপনার এ ধরনের ভূমিকায় আপনার প্রিয় মাতৃভাষাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আশা করি শুধুমাত্র ‘রীতি ভাঙার জন্য রীতি অমান্য’ করার কাজটি করবেন না। রীতি যদি ভাঙতেই হয়, তাহলে তথাকথিত যেসব শুদ্ধ (কিন্তু অপ্রমাণিত ও কম গ্রহণযোগ্য) রীতি এখনও আমাদের শৃঙ্খলিত করে রেখেছে সেগুলি ভাঙুন।

প্রশ্ন : ৬. ভাষা ব্যবহারকারীদের অন্তত অর্ধেক নিজের সারা শিক্ষাজীবন এই প্রমিত বানানরীতি ছাড়াই পার করে আসেননি? হঠাৎ কোনো প্রতিষ্ঠান বা চার-পাঁচজন মানুষ লাখ লাখ লোকের ২০ বছরের শিক্ষাকে ভুল বলবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না।

উত্তর : ‘বাংলা একাডেমী’ কোনো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান নয়, আমাদের জাতীয় পর্যায়ের সেরা মননশীল ব্যক্তিরা প্রমিত বানানরীতি প্রণয়নের সাথে জড়িত। মানা না-মানার দায়িত্ব আপনার। যিনি না-মানেন তিনি বুঝেই না-মানেন, আর যিনি না-বুঝে না-মানেন, তিনি নিঃসন্দেহে ভুলবশত না-মানেন। ‘বাংলা একাডেমী’র প্রমিত বানানরীতির বাইরের বানানকে যে-কেউ ভুল বানান বলে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন সহজেই, অন্তত আমি তা-ই মনে করি।

প্রশ্ন : ৭. ‘বাংলা একাডমী’ যে বিভ্রান্ত তার প্রমাণ তার নামের ‘একাডেমী’ বানানটিই।

উত্তর : কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নামের ক্ষেত্রে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রযোজ্য নয়। কাজেই ‘বাংলা একাডেমী’ তার নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য নয়। হঠাৎ করে এত পুরোনো একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নাম পরিবর্তন করা সম্ভব কি না তাও ভেবে দেখবার বিষয়। তবে বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য আমি ‘বাংলা একাডেমী’র নাম পরিবর্তনের পক্ষে। এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা তা-ই দেখতে পাব।

***
বাংলা ভাষার মতো এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন বানানরীতি বিশ্বের আর কোনো ভাষায় আছে কি? আরও পরিতাপের বিষয় এই ভিন্ন ভিন্ন বানানকে শুদ্ধ বানানের ট্যাগ পরিয়ে রাখা হয়েছে আজ অব্দি। সত্যিকার অর্থে এতে কি বাংলা ভাষার কোনো লাভ হয়েছে পাঠকদের বিভ্রান্ত করা ছাড়া? বাংলাদেশের ভাষাতত্ত্ববিদ ও অভিধানবিশারদেরা কেউ কি শুনছেন আমাদের কথা? আমাদের সাধারণ পাঠকদের এই আর্তনাদ কি পৌঁছাচ্ছে আপনাদের কানে? আমরা প্রমিত বানানরীতি মেনে চলতে চাই, প্লিজ হেল্প করুন আমাদেরকে।

(চলবে...)

*তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা : এই লেখাটির বেশ কিছু লাইন বিভিন্ন বাংলা ব্লগ সাইটের নাম না-জানা ব্লগারদের সাথে কথোপকথন ও ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক অভিধান’ থেকে সরাসরি কোট করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন