মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০১০

বাংলাদেশ ভ্রমণ গাইড- ১ | সংস্কৃতি ও স্থাপত্যরীতি |

লিখেছেন কুটুমবাড়ি (তারিখ: বুধ, ২০১০-০৭-২১ ০২:৫৩) @ সচলায়তন
ক্যাটেগরী: | | |

[size=24]ঠিকানা বাংলাদেশ![/size]

পাহাড় ও অরণ্য, মসজিদ ও মন্দির, সৈকত ও দ্বীপ—এই সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয়টি সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের, তা হচ্ছে তার নামটি—বাংলাদেশ! একসময় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি আর উপচে পড়া ভিড়ের জন্যই বেশি পরিচিত ছিলাম আমরা। ধীরে ধীরে সেই ভাবমূর্তির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। আমরা এখন মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখেছি, ক্রমেই হয়ে উঠছি বিশ্বায়নের সক্রিয় অংশীদার। ঐতিহাসিক করুণ পরিণতি বা উন্নয়নের পথে বারবার হোঁচট খাওয়া—কোনো কিছুই দমাতে পারেনি আমাদের। এখন আর বাংলাদেশ মানেই তলাবিহীন ঝুড়ি নয়—যেমনটি একসময় ধারণা ছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমের। বাংলাদেশ এখন ভালো খবর তৈরি করতেও শিখেছে।


বাংলাদেশের পর্যটন-সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা সাধারণভাবে নিজেদের সমতলের অধিবাসী ভাবতেই অভ্যস্ত, যদিও এখানে রয়েছে নোনাজলে ঘেরা আদিম পেরাবন (ম্যানগ্রোভ), প্রাচীন বৌদ্ধ রাজত্বের অদেখা নিদর্শন, অপূর্ব সমুদ্রসৈকত যা একসময় মনে হয় অনন্ত, মিঠাপানির ডলফিন (শুশুক) ও গভীর পানির হাঙর, বিস্তীর্ণ গাঢ় সবুজ চা বাগান, এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয় (তাজিনডং), যা স্কটল্যান্ডের উচ্চতম পাহাড়চূড়ার সমান উঁচু। সবাই বাঙালি নন, রয়েছে অনেকগুলো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। তা সত্ত্বেও এখানে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান শুধু সম্ভবই নয়, অলঙ্ঘনীয়ও বটে। তাই বুঝি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশকে, কেউ জানতে চাইলে তাঁরাও বলে ওঠে ঠিকানা বাংলাদেশ!

এই সবকিছুই প্রকাশ করছে প্রকৃত বাংলাদেশকে, আর সেই সাথে এই দেশ ভ্রমণে প্রকৃত রোমাঞ্চলাভের নিশ্চয়তাকেও।

[size=24]সংস্কৃতি[/size]

[size=18]শিল্প[/size]

ভারত এবং বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে সীমান্ত বিভাজন এঁকে দিলেও সমগ্র বাংলার অধিবাসীদের ভাষা, পোশাক, সংগীত, এবং সাহিত্য প্রায় একই রকম। প্রথমদিকে শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে বয়ন, মৃৎশিল্প এবং পোড়ামাটির প্রতিমাকে ঘিরে। গৃহ সরঞ্জাম এবং কাপড়ের প্রয়োজনীয়তাও ক্রমে নান্দনিক সৃষ্টির উপায় হয়ে উঠেছে।

[size=18]সাহিত্য[/size]

সাহিত্য চর্চার ইতিহাসও সুপ্রাচীন। রূপকথা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ পৌরাণিক কাহিনিগুলো বাংলায় অনূদিত হয়েছে দুই হাজার বছর আগে থেকে। মূলত নাট্যদলগুলোর গ্রামবাংলায় ঘুরে ঘুরে অভিনয় করার জন্য এই ধরনের সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে।

[size=18]জনসংখ্যা[/size]

প্রায় ১৫ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আয়তনের দিক থেকে দেশটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতর দেশের একটি হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে তাই ৭ম অবস্থানে আছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ঘনবসতি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, ১৩,১৮০ বর্গকি.মি. আয়তনের এই অঞ্চলে বাস করে মাত্র ১৫ লক্ষের মতো মানুষ।

[size=18]ধর্ম[/size]

বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম ইসলাম (৮৯.৭%)। তার পরেই আছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা (৯.২%)। মুসলমানদের অধিকাংশই সুন্নি, বাকিরা শিয়া, আহমেদিয়া অথবা সুফি। বিহারিদের (আটকে পড়া পাকিস্তানি) মধ্যে শিয়া মুসলমানের সংখ্যা বেশি। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ (০.৭%), খ্রিস্টান (০.৩%, অধিকাংশই রোমান ক্যাথলিক), এবং এনিমিস্টরা (০.১%)।

প্রায় ১৩ কোটি মুসলমান নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এখানে শান্তিতে তাদের ধর্ম পালন করে আসছে। তথ্যসূত্র—[url=http://en.wikipedia.org/wiki/Bangladesh#Religion]উইকিপিডিয়া[/url]

[size=18]আদিবাসী জনগোষ্ঠী[/size]

বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষাধিক। এদের অর্ধেকেরও বেশি কেন্দ্রীভুত হয়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এ ছাড়া উত্তর ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চল এবং সিলেট এলাকায় আদিবাসীরা রয়েছে প্রচুর সংখ্যায়। অন্যরা বাস করে নগর এলাকায়, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে [i]চাকমা, মগ, ম্রো (মুরং), মিজো, কুকি, বম, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গা, বনযুগী[/i] এবং [i]পাংখো[/i]। এখানকার প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠী [i]চাকমা[/i]রা। এর পরেই আছে মগ, এদের দেখা পাওয়া যায় কক্সবাজার এবং কুয়াকাটার সন্নিকটে খেপুপাড়া এলাকায়। এইসব আদিবাসীরা সমষ্টিগতভাবে ‘ঝুমিয়া’ নামেও পরিচিত, শব্দটি এসেছে ‘ঝুম’ থেকে যা তাঁদের চাষ পদ্ধতি।

সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় বাস করে যেসব আদিবাসী অর্থাৎ খাসিয়া, পাংখো এবং মনিপুরীরা সাধারণত তাদের বসতিসংলগ্ন পাহাড়ি বন্যভূমির বন্দোবস্তপ্রাপ্ত। তাদের কিছু অংশ সিলেটের ব্যবসায়ী এবং মণিকারে পরিণত হয়েছে।

গারো (অথবা মান্দি, যেমনটি তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে), হাদি, হঞ্জঙ্গি, দাহুউ, পালাই, বুনারা বাস করে উত্তর ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চলে, এবং হালুয়াঘাট, শ্রীবর্দি, কলমাকান্দা এবং গারো পাহাড়ে। ময়মনসিংহের পশ্চিমে, মধুপুর বনের আশেপাশেও কিছু আদিবাসী বাস করে।

অনেক চা বাগানের শ্রমিক সাঁওতাল এবং ওরাঁও জনগোষ্ঠীর, বৃটিশরা এদের নিয়ে এসেছিল পূর্ব এবং মধ্য ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। এরা ‘চা আদিবাসী’ নামেও পরিচিত। তাদের ধর্মে সংমিশ্রণ ঘটেছে সর্বপ্রাণবাদ (সব বস্তুর প্রাণ আছে—এই বিশ্বাস) এবং সাধারণ সনাতনী ধারার।

অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী যেমন কোচি, হু, মুন্দু এবং রাজবংশীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং বাকেরগঞ্জের মতো নগর এলাকায়।

ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসীরা মূলত অভিবাসিত হয়েছিল পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলো থেকে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা মিয়ানমার (বার্মা) থেকে। তাদের প্রত্যেকের আলাদা সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, শিল্প, পোশাক এবং চাষ-পদ্ধতি রয়েছে। অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বৌদ্ধ, যদিও কিছু গোষ্ঠী এখনও সনাতন প্রভাবিত সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম ধরে রেখেছে।

বেশির ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, তবে আধুনিক সভ্যতা অনুপ্রবেশ করছে তাদের ভূখণ্ডেও, ক্রমেই তাই তরুণরা পল্লি ছেড়ে শহরে ভিড় জমাচ্ছে কর্মসংস্থানের আশায়। উদাহরণ হিসেবে, চাকমারা এখন শাড়ি ও আদিবাসী জুয়েলারি তৈরি করে। তারা পশ্চিমী শিক্ষা ও পোশাক গ্রহণ করতে শুরু করেছে, এমনকি মন্ত্র এবং হার্বাল পদ্ধতি ছেড়ে অ্যালোপেথিক চিকিৎসার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

[size=24]স্থাপত্যরীতি[/size]

[size=18]মৌর্য এবং মৌর্য-পূর্ব যুগ (৪র্থ-২য় খ্রিস্টপূর্ব)[/size]

সহজলভ্য ও দেশীয় উপাদানে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতো এই সময় যা ‘বাংলা স্থাপত্য’ নামে পরিচিত। ছন ও বাঁশে ছাওয়া কুঁড়েঘর, যা আজও গ্রামবাংলায় চোখে পড়ে তা-ই ‘বাংলা স্থাপত্য’, জানামতে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যরীতি।

[size=18]গুপ্ত যুগ (৪র্থ-৭ম খ্রিস্টাব্দ)[/size]

এই সময়ের স্তূপ (বৌদ্ধ স্থাপনা) তৈরির সনাতন নকশাটি ছিল চার-কোণা বেদির ওপর গোলাকার স্থাপত্যবিশিষ্ট। মহাস্থানগড়, কুমিল্লা এবং পাহাড়পুরের পুরাকীর্তিগুলো গুপ্ত অধিষ্ঠানের চিহ্ন বহন করে চললেও পাহাড়পুরের কীর্তিগুলো এই সময়ের কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

[size=18]সেন যুগ (১২শ-১৩শ শতক)[/size]

এই সময়ে নির্মিত হিন্দু মন্দিরগুলোয় ভারতীয় প্রভাবের ছাপ সুস্পষ্ট। প্রকৃষ্ট উদাহরণটি পাওয়া যাবে পুঠিয়ায়। আরও পরে, হিন্দু মন্দিরগুলো ভারতীয় নকশার বদলে সম্পূর্ণ দেশীয় রীতিতে নির্মাণ করা হয়। দিনাজপুরের [i]কান্তজীর মন্দির[/i] তার একটি চমৎকার উদাহরণ।

[size=18]মুসলিম যুগ (১৩শ-১৭শ শতক)[/size]
[img=auto]http://www.flickr.com/photos/29676479@N02/2792970887/[/img]
তুর্কি খিলজিদের যুগ (১৩শ-১৫শ শতক) বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছে বাগেরহাটের বিখ্যাত [i]ষাট গম্বুজ মসজিদ[/i] এবং সোনারগাঁয়ের [i]গোয়ালদি মসজিদের[/i] কারণে। ১৫৭৬-১৭৫৭ সাল পর্যন্ত মুঘলরা বাংলা শাসন করে এবং পূর্ববর্তী মুসলিমরীতির সাধারণ নকশায় পরিবর্তন নিয়ে আসে, এমনকি এক্ষেত্রে ভারতে ব্যবহৃত সনাতনী নকশাও ব্যবহৃত হয়নি। সব সেরা উদাহরণ ঢাকার [i]লালবাগ দুর্গ[/i] এবং [i]সাত গম্বুজ মসজিদ[/i]।

[size=18]ব্রিটিশ যুগ[/size]

এ সময়ের উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য হিন্দু রাজবাড়ি (জমিদারদের নির্মিত প্রাসাদ), বিংশ শতকের প্রথম দু দশকে নির্মিত গণভবনগুলোও রয়েছে এই তালিকায়।

রাজবাড়িগুলো খুবই বড় জর্জিয়ান বা ভিক্টোরিয়ান কান্ট্রিহাউসের মতো দেখতে হলেও মালিকদের উদারনৈতিক ভাবধারার কারণে তাতে যুক্ত হয়েছে নব্য-রেনেসাঁর ছাপ যা বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলিতে মিশ্র স্থাপত্যরীতির সূচনা করেছে। দেশ ভাগের সময় থেকে রাজবাড়িগুলো পরিত্যক্ত হতে শুরু করায় অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুটি রাজবাড়ি খুব ভালো অবস্থায় আছে—[i]আহসান মঞ্জিল[/i] যা বর্তমানে জাদুঘর এবং [i]দীঘাপাতিয়া প্যালেস[/i] যা বর্তমানে সরকারি ভবন।

ব্রিটিশ যুগে অধিকাংশ সরকারি ভবন নির্মিত হয় মুঘলরীতি এবং রেনেসাঁর সমন্বয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের [i]কার্জন হল[/i] এবং রংপুরের [i]কারমাইকেল কলেজ[/i] এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

অনেক সরকারি সার্কিট হাউস ঢেউটিনের ছাদ এবং নিচু বারান্দা নিয়ে অনেকটাই বৃটিশ বাংলো ধাঁচের। একটি চমৎকার উদাহরণ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস যা বর্তমানে [i]জিয়া স্মৃতি জাদুঘর[/i]।

[size=18]আধুনিক স্থাপনা[/size]

সবচেয়ে আকর্ষণীয় আধুনিক স্থাপনাটি হলো [i]জাতীয় সংসদ ভবন[/i] যা বিখ্যাত স্থপতি লুই কানের নকশাকৃত। স্বীকৃত ইসলামিক স্থাপত্যটি হলো [i]বায়তুল মোকাররম মসজিদ[/i] যা খুবই তীক্ষ্ণ ও অতিরিক্ত রেখা নিয়ে খুবই দৃষ্টিনন্দন।

তথ্যসূত্র—[url=http://www.lonelyplanet.com/bangladesh]লোনলি প্লানেট বাংলাদেশ[/url] থেকে অনুবাদকৃত।
ছবি—Photographer: Amain Babu @ http://www.photo.com.bd/Life/pic003.jpg.html

(চলবে...)

কুটুমবাড়ি
mhdrakib@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন